দেশ মাতৃকার বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের তুল্যহীন ত্যাগ, লাখো শহীদের রক্ত আর হাজারো রমনীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের চলমান সন্ত্রাস, লুটপাট, গুম-খুন আর ধর্ষনের যে চিত্র সমাজ রাষ্ট্রে দৃশ্যমান-তা দেখে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা অধঃপতনের দ্বার প্রান্তে উপনীত। নীতি-নৈতিকতা, সম্প্রীতি, মানবতাবোধ, লজ্জা-শরম যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। উগ্র-সংস্কৃতি, যান্ত্রিক সভ্যতা-বিশেষতঃ সর্বনাশা মোবাইল আমাদের সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা কিশোর এবং যুবক শ্রেনীকে বিপথগামী করে ফেলেছে। জানি না এ সর্বনাশা পথ থেকে এদের প্রত্যাবর্তন আদৌ সম্ভব কি না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাদক দ্রব্য, যা মানুষকে সরাসরি ধ্বংস করে ফেলে। যে দেশে কাঁচা মরিচ আর পিয়াঁজ এর চেয়েও নেশাদ্রব্য সহজলভ্য- সে দেশবাসির অধঃপতন অনিবার্য।
সেদিন সংবাদপত্রে দেখলাম বাংলাদেশে ৮০ লক্ষের উপর যুবক-যুবতী নেশাগ্রস্ত। দেশের জনসংখ্যা যদি ১৮ কোটিও হয় তবে মোট জনসংখ্যার ২২.৫ শতাংশই নেশার জগতের বাসিন্দা। এতে নারীরাও পিছিয়ে নেই। মাদকাসক্তদের শতকরা ৫৭ ভাগ পুরুষ, আর ৪৩ ভাগ নারী। ক্যাসিনো স¤্রাজ্ঞী পাপিয়ার অধীনেই নাকি ১৭০০ নারী কাজ করতো! মাদকের টাকার জন্য বেড়ে গেছে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, পন আদায়। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে মা-বাবা খুনের ঘটনা এখন প্রায়ই প্রকাশ মাধ্যমে দেখতে পাই। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উশৃঙ্খলা। হারিয়ে গেছে সম্প্রীতি, সহনশীলতা-মানবতাবোধ।
সমাজ বিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে উগ্র সংস্কৃতি, আধুনিকতার নামে বেলেল্লেপনা, যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতি মোহ, ফ্যাশনের নামে নগ্নতা, নেশাদ্রব্যের সহজলভ্যতা, পারিবারিক বন্ধনের সিথিলতা- সারা পৃথিবীর মানুষকে অধঃপতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। তথা কথিত উন্নত বিশে^র পারিবারিক এবং সামাজিক আচরনকে অনুসরন করতে গিয়ে উন্নয়নশীল দেশের যুব সমাজ নীতি-নৈতিকতা বিসর্জনের প্রতিযোগী হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে। এরা জানেনা বা কেউ জানায়না আসলে যে দেশের কৃষ্টি-কালচারকে অনুসরন করছে, সে দেশের পারিবারিক অবস্থা কোন নরকে অবস্থান করছে? যেমন হলিউডের ছায়াছবি- যা আসলে অনৈতিকতা এবং নগ্নতারই বহিঃপ্রকাশ। পার্থিব স্বর্গ-পারিবারিক এবং সামাজিক চিত্রটি আসলে কেমন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরুন, সেখানে পারিবারিক বন্ধন বলতে তেমন কিছু নেই। সদ্যজাত শিশুটির আশ্রয় শিশু আশ্রমে- যা অনেকটা আমাদের দেশের এতিমখানার মতো। যে শিশুর বেড়ে উঠার কথা মায়ের বুকে, তার আশ্রয় অজানা সেবিকার তত্বাবধানে। অনেক শিশু জন্মের পর আর মায়ের ছোঁয়াও পায়না। বাবা তথা জন্মদাতাকে অনেকে জীবনেও দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৫৭ ভাগ মানুষ জারজ, ৫১ ভাগ মানসিক রোগাক্রান্ত। মনবৈকল্যের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি অপরাধের অভয়ারন্যে পরিনত হয়েছে। যেমন প্রতি ২৪ ঘন্টায় যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ৪৩,২০০টি বড় অপরাধ, সহিংস ঘটনা ২,৯২৭টি, সম্পত্তি আত্মসাৎ জনিত ঘটনা ৩৪,৫৬০টি, হত্যা জনিত ঘটনা ৪,১১৪টি, ধর্ষন ২৪০টি, ডাকাতি ১,৮৭৮টি, গুরুতর হামলা ৩,২০০টি, চুরি ৩৭,৪৪০টি, গাড়ি চুরি ৭,৬৫৪টি। (সূত্র ক্রাইম ইন দ্য ইউএসএ-১৯৯২ইং)
এছাড়া মানুষ বুড়ো হলে তাদের দেখার কেউ থাকেনা। মরে গেলে দুর্গন্ধ পেলে প্রতিবেশীরা মিউনিসিপ্যালিটিকে ফোন করলে তারা এসে লাস নিয়ে যায়। ইউরোপের অবস্থাও তথৈবচ। অথচ আমরা তাদের অনুসরন করছি!
অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে উগ্র সংস্কৃতির বিস্তার মানুষের ন্যায়বোধকে নির্বাসনে পাঠায়। আর এ নগ্ন সংস্কৃতির বিকাশে মোবাইল ফোনের ফেসবুক এবং অ্যাপসের অবদান সবচে’ বেশী। যারা সার্বক্ষনিক এ সব নগ্ন ছবি, আপত্তিকর দৃশ্যাবলী দেখেন- সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে ফেলেন নীতিবোধ। এর সাথে যুক্ত সহজলভ্য নেশাদ্রব্য। আমাদের দেশে নেশাগ্রস্ত যুবক-যুবতীর সংখ্যাই ৮০ লাখের উপর। এর মাঝে পুরুষ শতকরা ৫৭ভাগ আর নারী শতকরা ৪৩ ভাগ। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের জাতি সত্বার ভবিষ্যৎ কি? আর এ নেশাদ্রব্যের ব্যবসার সাথে যারা জড়িত-তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও পদ পদবী দেখলে হতবাক হতে হয়। নেশা দ্রব্যের সহজলভ্যতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে লুটপাট, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ এবং খুন। ৩ বছরের শিশু এবং ৭০ উর্ধ বয়সী বৃদ্ধা রমনীও ধর্ষিতা হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আর এতে সমাজ রাষ্ট্রের সকল পেশাধারীই যার যার অবস্থান থেকে অবদান রেখে চলছেন। তাইতো দেখছি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, মাদ্রাসা-এতিমখানার শিক্ষকগনও ধর্ষনে লিপ্ত। গনধর্ষন এখন ফ্যাসনে পরিনত হয়েছে। পত্রিকায় যখন দেখি শামিমা নুর পাপিয়ার অধীনেই ১৭০০ সুন্দরী নারী এবং খদ্দের এমপি এবং মন্ত্রী, তখন নিজকে এদেশের নাগরিক ভাবতেও লজ্জাবোধ করি। এ ক্যাসিনো স¤্রাজ্ঞির রাজনৈতিক পরিচয় বিবেককে পীড়া দেয়। দুঃখ হয় যে দেশের বিশিষ্ট লেখক ও বিশ^ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, “মেয়েদের চকলেটের মতো চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করে এবং একজন শিক্ষিতা ডাক্তার নারী উদোম গায়ে নারীদের চলাফেলা এবং দাঁড়িয়ে প্র¯্রাব করার দাবী জানায়- সে দেশের সামাজিক অবক্ষয় রোধ করবে কে?
বর্তমান ২০২০ সালের শুধু ফেব্রুয়ারী মাসেই ধর্ষিতা ১১৪ জন, শিশু ৭৪জন, গনধর্ষনের শিকার ২৪জন, ধর্ষনের পর হত্যার শিকার ৯জন, যৌন নির্যাতীতা ১০ জন, ধর্ষনের পর দ্বিতীয়বার ঐ কন্যাকে ধর্ষন করতে গিয়ে মেয়েটিকে না পেয়ে মেয়েটির মা-বাবাকে অমানষিকভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়, নোয়াখালির সুধারামের খলিফার হাট এলাকায় ৭ম শ্রেনীর ছাত্রি বখাটেদের অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে, পিরোজপুর শহরে বিয়ের আসর থেকে কনেকে ঝাপটে ধরে শ্লীলতাহানি ঘটায়, খুলনার তেরখাদায় ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্রীকে ধর্ষন করেন পুলিশ সদস্য, ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করেন নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক-ছাত্রীটি এর বিচার চেয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে জগন্নাথ বিশ^ বিদ্যালয়ের প্রশাসন উল্টো ছাত্রীটিকেই বিশ^ বিদ্যালয় হতে বহিস্কার করেন, বগুড়ায় বি.এম. মডেল স্কুল ও কলেজের ছাত্রীদের যৌন হয়রানির কারনে বাংলা ও ইংরেজী বিভাগের ২ শিক্ষক বরখাস্ত, নোয়াখালির সোনাইমুড়ি থানার এস,আই- প্রবাসিদের ঘরে হানা দিয়ে ইয়াবা কেইসে ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মহিলাদের ধর্ষন করতেন, কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জে ৬ বছর বয়সি কন্যা শিশুকে তুলে নিয়ে ধর্ষন করে ৫৫ বয়সী বৃদ্ধ, মুমূর্ষ স্বামীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে ধর্ষনের শিকার, গাজীপুরের ধলাদিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ৫ম শ্রেনীর ছাত্রীকে আড়াই মাস আটকিয়ে রেখে ধর্ষন করে, প্রতিবন্ধিরাও অহরহ ধর্ষনের শিকার হচ্ছে, বাদ যায় না বিধবারাও। বাবার সামনে থেকেও মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষনের চেষ্টা করা হয়!
এইতো গেলো ধর্ষনের চিত্র। ঘুষ-লুটপাট, জবর দখল ও চাঁদাবাজির আজাবে জাতি দিসেহারা। সরকারী অফিস-আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ^ বিদ্যালয় প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনীর কান্ড কীর্তি দেখলে মনে হয় আমরা পতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। জাতির ভবিষ্যৎ যুব শ্রেনীর অসংযত উচ্ছৃঙ্খল আচরনই প্রমান করে আমাদের প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎ ঘন অমানিশার আঁধারে হারিয়ে গেছে। মানুষ হত্যা এখন ফ্যাসনে দাঁড়িয়েছে। আইনী শাসন শুধুই ফাঁকা বুলি। আদর্শবিহীন রাজনীতি সমাজ রাষ্ট্রের অধঃপতনের মারাত্মক জীবানু- যা করোনা ভাইরাস হতেও জঘন্য। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতি নাগরিকদের আস্থাহীণতা, আইনী শাসনের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়ই বর্তমান অমানবিক সমাজ চিত্রের জন্য দায়ী। আইনের প্রতি আস্থা থাকলে মানুষ মানুষকে পিটিয়ে মারতে পারেনা। গত সাড়ে ছয় বছরে ৪৮৬জন আদম সন্তান গন পিটুনীতে নিহত হয়েছেন। পুলিশি নির্যাতন আর ক্রস ফায়ারে নিহতদের সংখ্যা শুধু আলেমুল গায়েবই জানেন। আর এসব ঘটনার কোন বিচার হয়নি বলেই এ ধরনের হত্যাকান্ড এখন নৈমত্তিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। এ সমাজে বেড়ে ওঠা শিশুদের ভবিষ্যৎ কি?
আজকে একটি দৈনিকে দেখলাম বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার মাথাইল চাপড় গ্রাম সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে পুরুষ শূন্য। ভীতিগ্রস্ত বাড়ীতে চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন। অবস্থা দৃশ্যে মনে হচ্ছে ‘৭১ এর রাজাকার আলবদর তথা হানাদার পাক-বাহিনীর পুনরোত্থান। কিভাবে একটি দেশে এতো অবৈধ অস্ত্রধারী ঘুরে বেড়ায়? কোথায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের বাস্তব পদক্ষেপ? অবস্থা দৃশ্যে মনে হয় আমরা ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম বাগানের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছি। এখনও সময় আছে সরকার ও জনগন এককাট্টা হয়ে শক্ত হাতে এ জাহেলী আচরনের পতন ঘটাতে হবে। অন্যথায় আমাদের পতন শুধুই সময়ের ব্যাপার।
ঢাকাঃ ১লা নভেম্বর ২০২০ইং।
Leave a Reply